রাখাইন করিডোর নিয়ে চীন-রাশিয়া বৈঠক: প্রক্সিযুদ্ধের আশংকা ও ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন

 
প্রতীকী ছবি


রাখাইন করিডোর ইস্যু বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যেখানে চীন ও রাশিয়া প্রক্সিযুদ্ধ এড়াতে এবং নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় তৎপর। সাম্প্রতিক সময়ে এই ইস্যুতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বৈঠক হয়েছে, যা এই জটিল পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

রাখাইন করিডোর ও এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব:

রাখাইন রাজ্য মিয়ানমারের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত এবং এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় এটি চীন, ভারত এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত। বিশেষত, চীনের "বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ" (BRI) এর অংশ হিসেবে রাখাইনে চাউকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর এবং একটি অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তোলা হচ্ছে, যা চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে ভারত মহাসাগরের সংযোগ ঘটাবে। এটি চীনের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগ সহজ করবে। ভারতেরও রাখাইনে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট প্রজেক্ট (KMTTTP) নামে একটি বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে।

রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে মিয়ানমার জান্তা সরকার এবং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (AA) মধ্যে তীব্র সংঘাত চলছে। আরাকান আর্মি রাখাইনের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে নিয়েছে, যা জান্তা সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই সংঘাতের ফলে মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের নতুন করে বাংলাদেশে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রক্সিযুদ্ধের আশঙ্কা:

রাখাইন করিডোর ইস্যু নিয়ে একটি প্রক্সিযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যেখানে পরাশক্তিগুলো সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে স্থানীয় পক্ষগুলোকে সমর্থন দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা একদিকে এবং চীন ও রাশিয়া অন্যদিকে, এই দুই পরাশক্তি বলয়ের মধ্যে মিয়ানমার ইস্যুতে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্পষ্ট। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কোনো প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ নেই, বরং যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে অকার্যকরতা দেখা গেছে, যা মিয়ানমারে চীনের প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। তবে, কিছু মহল মনে করে যে পশ্চিমা শক্তিগুলো বাংলাদেশকে ব্যবহার করে মিয়ানমারে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করতে চাইছে।

অন্যদিকে, চীন এবং রাশিয়া উভয়ই মিয়ানমার জান্তা সরকারের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী। মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং নিজেদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষা উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আরাকান আর্মির উত্থান এবং জান্তা সরকারের দুর্বলতা চীন ও রাশিয়ার বিনিয়োগকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

চীন-রাশিয়ার বৈঠক:

রাখাইন করিডোর নিয়ে প্রক্সিযুদ্ধ ঠেকাতে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় চীন ও রাশিয়া সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি, রাশিয়ার মধ্যস্থতায় মস্কোতে মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লেইংয়ের সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সামরিক কুচকাওয়াজের ফাঁকে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং রাখাইনে আরাকান আর্মির প্রভাব মোকাবিলা করা। চীন মূলত তার অর্থনৈতিক স্বার্থ, বিশেষত চাউকপিউ বন্দর এবং করিডরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগ্রহী। রাশিয়াও মিয়ানমারে তার অস্ত্র বিক্রির বাজার এবং প্রভাব বজায় রাখতে চায়। এই বৈঠকটি রাশিয়া ও চীনের মধ্যে মিয়ানমার নিয়ে সমন্বিত সহযোগিতার ইঙ্গিত দেয়।

বাংলাদেশের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ:

রাখাইন পরিস্থিতি এবং মানবিক করিডোর ইস্যু বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাখাইনে মানবিক করিডোর প্রদানের নীতিগত সম্মতি দিয়েছে, তবে কিছু শর্তসাপেক্ষে। এই শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, সহায়তা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে পৌঁছানো এবং এর কোনো অংশ যেন সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে না যায়। বাংলাদেশ নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল রোধ করতে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ সুগম করতে আগ্রহী।

তবে, এই মানবিক করিডোর প্রদানের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। কারণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে মানবিক করিডর প্রায়শই নিরাপত্তা সংকট তৈরি করে এবং এতে সামরিক বিষয়গুলো জড়িত হতে পারে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এই জটিল পরিস্থিতিতে "শ্যাম রাখি না কূল রাখি" অবস্থায় পড়েছে। একদিকে জাপান (যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র) বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বার্তা দিয়েছে, অন্যদিকে রাখাইন করিডোর ইস্যুতে দেশের ভেতরেও অস্বস্তি চলছে। দেশের সবকটি রাজনৈতিক দল এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

Post a Comment

أحدث أقدم