গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার : বাংলা গানের জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম

 
গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার

“শোনো একটি মুজিবরের থেকে  লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশেবাতাসে ওঠে রণী - বাংলাদেশে আমার বাংলাদেশ।“ এবং “মা-গো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি, তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।“

এ গান দুটি বাংলাদেশের মুক্তিযূদ্ধের নয়মাস বাঙালির হৃদয়ে এক প্রবল অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো। গান দুটির গীতিকার হলেন বাংলাদেশের পাবনায় জন্ম নেয়া ভারতীয় গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার। ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বাজানো হয়েছিলো।

 

 

গত ০৫ ডিসেম্বর ছিলো বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জন্মদিন। ১৯২৪ সালের এই দিনে বাংলাদেশের পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার ডাক নাম ছিলো ‘বাচ্চু’। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের বাবা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ছিলেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ।

 

শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী। শিক্ষাজীবনে কবিতা ও সাহিত্যে তার অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় মেলে। ছাত্র অবস্থায়ই তিনি কালিদাসের ‘মেঘদূতম’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

 

প্রথমে কবি হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে গীতিকার হিসেবে বাংলা সঙ্গীত জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার লেখা বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গান সঙ্গীতাঙ্গনকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। শব্দচয়ন ও ভাবনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ। তর লেখা “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই” গানটি বিবিসির ২০০৪ সালের জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান পায়।

 

শচীন দেব বর্মণের সান্নিধ্যে তিনি গানের জগতে প্রবেশ করেন। শচীন কর্তা তাকে ‘কলকাতার মজরুহ সুলতানপুরী’ বলে ডাকতেন। তাদের যুগলবন্দিতে সৃষ্টি  হয়েছিলো ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’-এর মতো বহু কালজয়ী গান। তার লেখা গান গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায় সহ অনেক কিংবদন্তি শিল্পী।

 
মান্না দে ও গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’, ‘ও নদী রে’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘কেনো দূরে থাকো - শুধু আড়াল রাখো’, ‘আমার গানের স্বরলিপি’, ‘মাগো ভাবনা কেনো’ সহ অসংখ্য গান বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে চিরকালীন স্থান দখল করে আছে। তার আরেক অমর সৃষ্টি “শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি” গানটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণার এক বলিষ্ঠ ‘শব্দ হাতিয়ার’ হয়ে ওঠে।

 

১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান তিনি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে গেলে শেষবারের মতো তার পৈতৃক ভিটায় যান। তার জন্মস্থান গোপালনগর গ্রামে বর্তমানে একটি ৫০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে, যা বাংলাদেশ সরকার তার পৈতৃক জমিতে প্রতিষ্ঠা করে। তবে দুঃখজনকভাবে সেখানে তার কোনো স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়নি।

 

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার জীবনের শেষ ১০ বছর ক্যান্সারে ভুগে ১৯৮৬ সালের ২০ আগষ্ট প্রয়াত হন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘‘কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে গীতিকারদের স্থান দেওয়া হয় না। অথচ গান লিখতে কবিতা নয়, একেবারে আলাদা এক ধরনের ভাষা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়।’’

 

বাংলা সঙ্গীতের স্বর্ণযুগে তিনি ছিলেন এক নেপথ্য নায়ক। তার অসামান্য সৃষ্টিকর্ম বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। অন্তর থেকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি তাঁকে।

(সংগৃহীত ও সম্পাদিত)






Post a Comment

أحدث أقدم