পুলক বন্দোপ্যাধ্যায় – আধুনিক বাংলা গানের জগতে বহুল উচ্চারিত নাম

 
পুলক বন্দোপ্যাধ্যায়

মান্না দে ছিলেন ওনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একবার মুম্বাইতে তিনি গিয়েছেন মান্না দে'র বাড়ি। গিয়ে দেখলেন, রান্নাঘরে মান্না।

বললেন, ‘‘রান্না করছেন! কী রান্না?’’

মান্না দে বললেন, ‘‘তা তো বলব না আগে থেকে। আগে রান্না শেষ হোক। খেয়ে দেখুন। তারপর আপনাকেই বলতে হবে যে!’’

একটু পরে মান্না দে বসার ঘরে গিয়ে দেখলেন, উনি একটা কাগজে লিখে ফেলেছেন বেশ কয়েকটা লাইন।

মান্না দে বললেন, ‘‘কী ব্যাপার? কিছু লিখে ফেললেন নাকি এখন?’’

উনি বললেন, ‘‘এটা লিখলাম!’’

সেই লেখা হল, বিখ্যাত গান ‘আমি শ্রীশ্রী ভজহরি মান্না’।

 

####

একবার এয়ারপোর্ট থেকে মান্না দে কে রিসিভ করে ফিরছেন উনি।

পথে মান্না দে একটি ঠুংরি গুনগুন করছিলেন। ঠুংরিটি কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে শেখা ‘শ্যাম, ঘুংঘট কে পট খোলো’। হঠাৎ ওনাকে মান্না দে বললেন, ‘‘এইরকম একটা গান লিখুন তো মশাই।’’ পথে যেতে যেতেই গানের কথা এল ওনার মনে। ততক্ষণে শ্যামবাজার...!

বললেন, ‘‘গানটা এসে গেছে মশাই, নেমে পড়ুন, এখনই করে ফেলা যাক।’’

কাছেই গানের স্কুল বাণীচক্র।

সেখানে গিয়ে একটি ঘর চেয়ে নিয়ে, হারমোনিয়াম আর খাতা পেন নিয়ে বসে পড়লেন দুই শিল্পী। জন্ম হল নতুন গানের। কোন গান? ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না।’

 

####

একবার, পুজোর আগে সিন্ধ্রি খনি অঞ্চলে একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়েছেন মান্না দে। সে বার সঙ্গে ছিলেন তিনি। সেই এলাকায় তাঁর ভায়রা-ভাই গৌরীসাধন থাকতেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না। মান্নাকে গাড়িতে বসিয়ে, বাড়ি খুঁজতে গেলেন। একটু পরে ফিরলেন হাসতে হাসতে। বললেন,

‘‘মান্নাদা, আপনার পুজোর গান তৈরি হয়ে গেছে!’’

মান্না দে তো খুব অবাক! গাড়িতে বসতেই মান্না দে বললেন, ‘‘সে কী মশাই? আমি তো এখান থেকে দেখতে পেলাম আপনি ওই বাড়িতে গেলেন, কলিংবেল টিপলেন, কে যেন দরজা খুলে আপনাকে কী বলল আর আপনিও দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন। এর মধ্যে গান তৈরি হল কী করে?’’

উনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? বলছি তো নতুন গান তৈরি হয়ে গেছে।’’

মান্না দে বললেন, "কি গান ?"

উনি বললেন, একটা ভুল বাড়ির দরজার কলিংবেল বাজিয়েছিলাম। বেলের শব্দে এক ‘অসাধারণ’ সুন্দরী দরজা খুলে ভুল ভাঙিয়ে দেন। কিন্তু ততক্ষণে মাথায় এসে গেছে গান। লিখে ফেললাম “ও কেন এত সুন্দরী হল? এমনি করে ফিরে তাকালো! দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই! আমি তো মানুষ!”

 

###

একদিন উনি বিমানে যাত্রা করছেন। সুন্দরী বিমানসেবিকাকে দেখে প্লেনের উইন্ডো সিটে বসে ন্যাপকিনে লিখেছিলেন, ‘ও চাঁদ, সামলে রাখো জোছনাকে।’

এক সুন্দরী মহিলার কান থেকে পড়ে যাওয়া ঝুমকো কুড়িয়ে ফেরত দিতে দিতে লিখেছিলেন মান্না দে'র গাওয়া মহার্ঘ গান, “জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা মতি খসে পড়েছে।“

 

৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯। গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে হারিয়েই গেলেন সেই মানুষটি |

চিনতে পারলেন তাঁকে?

তিনি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।

 

শোক জানাতে গিয়ে মান্না দে লিখেছিলেন, ‘‘পুলকের মতো জীবনরসিক লোক আত্মহত্যা করবে এটা আমার জীবনের সবচেয়ে অকল্পনীয় অনুভূতিগুলোর মধ্যে একটা। এখন শুধু মনে হচ্ছে, বন্ধু, এত বড় ফাঁকি দিলে- আমার সঙ্গে ভাগ করে নিলে না তোমার যন্ত্রণা!... ওর বাড়ির লোকের কাছে জানতে চাইব, কী এমন ঘটল যে, এত বড় জীবনরসিক মানুষটাকে নৌকো থেকে ঝাঁপ দিতে হল!’’

 

যতদিন স্বর্ণযুগের বাংলা গান থাকবে, ততদিন থেকে যাবে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম।

শ্রদ্ধার্ঘ্য।

 

© অহর্নিশ

তথ্য : ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা (আবীর মুখোপাধ্যায়)

 


Post a Comment

أحدث أقدم