![]() |
চাঁদপুরের সেই ইমাম বেঁচে আছেন। ছবিঃ NTV |
ভূমিকা
আমাদের সমাজে
বিভিন্ন ধর্মীয় মতাবলম্বীদের মধ্যে মতভেদ থাকা স্বাভাবিক। তবে কিছু ব্যক্তি বা
গোষ্ঠী নিজেদের মতবাদকে একমাত্র সঠিক দাবি করে অন্যদের বিশ্বাসকে অবমাননা করে
থাকেন। এতে সমাজে বিভেদ ও সহিংসতা সৃষ্টি হয়, যা
ইসলামের শিক্ষা ও মানবিকতার পরিপন্থী।
ইসলাম শান্তি, সহনশীলতা ও পারস্পরিক সম্মানের ধর্ম। মতভেদ থাকা স্বাভাবিক,
তবে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত, সহিংসতার মাধ্যমে নয়। সম্প্রতি চাঁদপুরে মসজিদে ইমামের উপর হামলার ঘটনা আমাদের সমাজে
ধর্মীয় সহনশীলতার অভাবের একটি দৃষ্টান্ত।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের উচিত ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অনুসরণ করে
সহনশীলতা ও পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখা, যাতে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত
হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনার আলোকে এই অধমের
একটি সামান্য বিশ্লেষণ।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার পটভূমি: মসজিদে রক্তাক্ত জুমা
সম্প্রতি
চাঁদপুরের এক মসজিদে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক
চেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। জুমার নামাজ চলাকালে এক মুসল্লি হঠাৎ ইমামের ওপর
চাপাতি নিয়ে হামলা চালান। তাঁর ভাষ্যমতে ইমাম সাহেব নাকি নবীজি (সা.)-কে “পিয়ন”
বলে অবমাননা করেছেন এবং মিলাদকে “বিদআত” আখ্যা দিয়েছেন। তাই তিনি মনে করেছেন এ
ধরনের ‘অপমানের’ জবাব চাপাতির ঘায়ে দেওয়া কর্তব্য!
ঘটনাটি
যতটা ভয়াবহ, তার চেয়েও ভয়াবহ এর পেছনের চিন্তাধারা। এটি আমাদের সমাজকে কিছু
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়:
- একজন মুসলিম কি বিচারকের ভূমিকা
নিতে পারে?
- নবীপ্রেম কি কারো জীবন কেড়ে
নেওয়ার বৈধতা দেয়?
- ইসলাম কি প্রতিশোধকে উৎসাহিত
করে, নাকি সহনশীলতা ও সংযমকে?
“নবী পিয়ন”—অপমান না উপমা?
ইমাম
সাহেব যদি সত্যিই বলেন, “নবীজি পিয়নের মতো, তিনি আল্লাহর বার্তা বহন করেন”—তবে এটি
অবমাননাকর না-ও হতে পারে। বরং এটা একটি রূপক বা উপমা হিসেবেই দেখা যেতে পারে।
রাসূল
শব্দের অর্থই হলো ‘বার্তাবাহক’। আর পিয়নের কাজ কী? অফিসে অফিসে বার্তা বা চিঠি
পৌঁছে দেওয়া। এ উপমা হয়তো একজন ধর্মীয় বক্তা আল্লাহ ও নবীর সম্পর্ক বোঝাতে
ব্যবহার করেছেন—যেখানে নবীজি আল্লাহর প্রেরিত বার্তাবাহক, একনিষ্ঠ বান্দা ও রাসূল।
কিন্তু
আমাদের সমাজে এখন ব্যাখ্যা না শুনেই ‘ফতোয়া’ এবং প্রতিশোধের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
যুক্তি বা আলোচনার আগেই রায় এবং সেই রায়ের ‘শাস্তি’ হয়ে যায় চাপাতির কোপ।
ঈমানের মূল: আল্লাহর প্রেম না প্রতিশোধ?
কুরআন
স্পষ্ট করে বলছে:
“বল, আমার
নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু—সবই আল্লাহর জন্য।”
— (সূরা আন’আম ৬:১৬২)
নবীজি
নিজেও বলে গেছেন:
“তোমরা
আমাকে ঈশ্বর বানিও না। আমি কেবল তাঁর বান্দা।”
— (সহীহ বুখারী, মুসলিম)
নবীপ্রেম
ইসলামি জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। কিন্তু সেই প্রেম যদি কাউকে খুনের দিকে ঠেলে দেয়,
তাহলে প্রশ্ন ওঠে—এই প্রেম কি ধর্মভিত্তিক, না আবেগ-ভিত্তিক উগ্রতা?
নবীপ্রেম
মানে কী হওয়া উচিত—ক্ষমাশীলতা, নম্রতা ও সহনশীলতা, নাকি প্রতিশোধ, হিংসা ও
রক্তপাত?
ইসলাম কি প্রতিশোধের ধর্ম?
কুরআনের
হুকুম স্পষ্ট:
“তোমরা
অন্যায়ভাবে কারো জীবন হরণ করো না। আল্লাহ এর বিচারক।”
— (সূরা ইসরা ১৭:৩৩)
নবীজির
জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই সহনশীলতার শিক্ষায় ভরপুর। তায়েফে তাঁকে পাথর ছুঁড়ে
রক্তাক্ত করা হয়েছিলো। ফেরেশতা এসে বলেছিলেন—ইচ্ছে করলে ওই জনপদ ধ্বংস করে দেওয়া
যাবে। কিন্তু নবীজি বলেছিলেন:
“হে
আল্লাহ! এদের হেদায়েত দাও। তারা জানে না।”
আজ যারা
নবীজির নাম করে খুন করছে, তারা আদতে কি নবীজিকেই অনুসরণ করছে, না নিজেদের রাগ,
প্রতিহিংসা ও বিকৃত ধর্মচেতনার পথেই হাঁটছে?
মসজিদে চাপাতি: ধর্মের বিপরীতে সহিংসতা
মসজিদ এমন
একটি স্থান, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির জন্য আসে, নিজের ভেতরের অন্ধকার দূর করে
আলোর পথে ফেরার চেষ্টা করে। অথচ সেখানে ইমামের মাথায় চাপাতির কোপ পড়ে। এ দৃশ্য
শুধু হৃদয়বিদারক নয়, বরং এটি ধর্মীয় ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও চরম বিভ্রান্তিকর।
ভিন্নমত
মানেই যদি শত্রুতা হয়, ব্যাখ্যার জবাব যদি হয় রক্ত, তাহলে আমরা পশুত্বের দিকেই
এগিয়ে যাচ্ছি।
ধর্মের নামে অন্ধত্ব: বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে?
আজকের
বাংলাদেশে ধর্মের নামে এমন এক উগ্রতার বিস্তার ঘটছে, যা শুধু সমাজকেই বিভক্ত করছে
না, বরং ধর্মকেও কলুষিত করছে।
নবীজির
জীবনের শিক্ষাগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। তাঁর ক্ষমাশীলতা, মানবতা, যুক্তিবাদিতা
আর আলোচনার মনোভাব যেন আমাদের ধর্মচর্চা থেকে দূরে সরে গেছে।
মসজিদে
নামাজের বদলে চাপাতির আওয়াজ, ব্যাখ্যার বদলে রক্তপাত—এ এক ভয়ংকর স্খলন।
শেষ কথা: আলো ফেরাও, অন্ধতা নয়
ধর্ম
কখনোই চাপাতির হাতিয়ার নয়। ইসলাম আলো ও যুক্তির পথ দেখায়, প্রতিহিংসার নয়। নবীজি
(সা.) তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ক্ষমা, সহানুভূতি ও আলোচনার চর্চা করেছেন। সেই
নবীজির নাম নিয়ে কেউ খুন করলে, সে আসলে নবীজির পথেই নেই।
ধর্মকে
রক্ষা করতে হলে, প্রথমে আমাদের সেই ধর্মীয় মানবতাকে বাঁচাতে হবে। ভালোবাসা মানে
হত্যার লাইসেন্স নয়। ব্যাখ্যা না বুঝে রায় দেওয়া ইসলাম নয়।
নবীজি
বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন:
“ভাই,
তুমি আমার কথাই বুঝোনি। তুমি আল্লাহর পথে নয়, নিজের রাগের পথে চলেছো।”
ধর্ম হোক
আলো, চাপাতি নয়। মসজিদ হোক শান্তি ও সংলাপের স্থান, সংঘাতের নয়।
এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পেতে আপনি চ্যানেল আই-এর প্রতিবেদনটি দেখতে পারেন:
সূত্রসমূহঃ
YouTube+13
Channel 24+13
Bangla Tribune+13
Prothomalo+5
NTV Bangla+5
দৈনিক জনকণ্ঠ || Daily Janakantha+5
priyochandpur.net
إرسال تعليق