সর্বনাশা “জিহাদি ড্রাগ” ক্যাপটাগন (Captagon)

 

ছবিঃ গুগল থেকে

ভূমিকা

ক্যাপ্টাগন (Captagon)- এক সর্বনাশা ড্রাগ, যা “জিহাদী ড্রাগ” নামেও পরিচিত। এটি এমন একটি ড্রাগ যা সেবন করলে শরীর ও মনের উপর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সেবনকারী তীব্রভাবে উত্তেজিত ও ভয়হীন হয়ে ওঠে। এটি এমন একটি নেশাদ্রব্য, যা সেবনকারীকে হিংস্র ও নিষ্ঠুর করে তোলে। এটি আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ায়।

ক্যাপটাগন ড্রাগ কী? কোথা থেকে এর উৎপত্তি, এটি কারা সেবন করে এবং এর ভয়াবহ প্রভাব সম্পর্কে জানুন এই বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধে।

 

বিস্তারিত

‘Captagon’—শুনতে হয়তো নতুন, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এটি একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত নাম। একে অনেকে “জিহাদি ড্রাগ” নামেও চেনেন। এটি এমন এক ধরনের নেশাদ্রব্য, যা শুধু মাদকসেবীদের মধ্যেই নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক, জঙ্গি এমনকি কিশোরদের মাঝেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

কী এই ক্যাপটাগন? কোথা থেকে এর উৎপত্তি? এবং কেন এটি নিয়ে এত উদ্বেগ? আসুন খুঁজে দেখা যাক।

 

উৎপত্তির ইতিহাস

Captagon মূলত একটি ব্র্যান্ড নাম, যার সক্রিয় উপাদান ছিল fenetylline—এক ধরনের সিন্থেটিক স্টিমুল্যান্ট (উত্তেজক)।

(১)  ১৯৬০ সালে জার্মানিতে এটি প্রথম তৈরি হয়।

 

(২)  ADHD (Attention Deficit Hyperactivity Disorder), নারকোলেপসি এবং হতাশা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো।

(৩)  এটি ছিল amphetamine ও theophylline-এর যৌগিক রূপ।

 

তবে ১৯৮০’র দশক থেকে ইউরোপ ও আমেরিকান দেশগুলোতে এই ড্রাগকে বিপজ্জনক এবং আসক্তিকর বলে ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।

 

ক্যাপটাগন-এর বর্তমান রূপ

আজকের যে “ক্যাপটাগন” বাজারে পাওয়া যায়, তা আর মূল “fenetylline” নয়। বর্তমান বাজারে যে ক্যাপসুল বা ট্যাবলেটগুলো পাওয়া যায়, তার ভিতরে মূলত রয়েছে:

(১)  Amphetamine

(২)  Caffeine

(৩)  Ephedrine

(৪)  কখনও কখনও মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ, যেমন – টকসিক ফিলার

অর্থাৎ এখনকার Captagon হলো নকল ও অবৈধ রাসায়নিকের মিশ্রণ যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

 

এটি কোথায় তৈরি হয় এবং কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে

বর্তমানে Captagon উৎপাদনের প্রধান ঘাঁটি হলো সিরিয়া

(১)  সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সেখানে রাষ্ট্রীয় ও মিলিশিয়া পর্যায়ে Captagon উৎপাদনের এক বিশাল অবৈধ কারখানা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে।

(২)  আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সিরিয়ার আসাদ সরকার ও তার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক চক্র এটি উৎপাদন ও পাচারের সঙ্গে জড়িত।

(৩)  প্রতিবেশী দেশ লেবানন, জর্ডান, তুরস্ক এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো—বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—এই ড্রাগের বড় বাজার।

সৌদি আরবে প্রায় প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ক্যাপটাগন ট্যাবলেট আটক করা হয়।

 

কারা খায় ক্যাপটাগন

Captagon এর প্রধান ভোক্তা কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত:

(১)  যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক ও আত্মঘাতী জঙ্গিরা:

a.     ISIS বা অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা দীর্ঘ সময় জাগ্রত ও তীব্রভাবে উত্তেজিত থাকার জন্য এটি সেবন করে।

b.     এই ড্রাগ নেশার কারণে তারা ভয়হীন ও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে।

 

(২)  কিশোর ও তরুণরা:

a. মধ্যপ্রাচ্যে তরুণ সমাজের মধ্যে নেশা, দুঃসাহস, আত্মবিশ্বাস ও ক্লান্তি দূর  করার জন্য এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

 

(৩)  পেশাজীবীরা:

a.  দীর্ঘ সময় কাজ করার জন্য কিছু চালক, শ্রমিক ও নিরাপত্তা কর্মী এটি সেবন করে—যদিও এটি অবৈধ।

 

সেবনের প্রভাব

Captagon এক ধরনের উচ্চমাত্রার উত্তেজক মাদক, যার প্রভাব শরীর ও মনের উপর ভয়াবহ হতে পারে।

 

শরীরের উপর প্রভাব:

(১)  অতিরিক্ত শক্তি ও কর্মক্ষমতা অনুভব

(২)  ক্ষুধা কমে যাওয়া

(৩)  নিদ্রাহীনতা

(৪)  হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া

(৫)  উচ্চ রক্তচাপ

 

মানসিক প্রভাব:

(১)  কল্পনা বৃদ্ধি (hallucination)

(২)  ভয় ও উদ্বেগ

(৩)  আগ্রাসী আচরণ

(৪)  আত্মবিশ্বাসের মিথ্যা অনুভূতি

 

দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি:

(১)  আসক্তি

(২)  মানসিক ভারসাম্যহীনতা

(৩)  হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি

(৪)  আত্মহত্যার প্রবণতা

 

ক্যাপটাগন ও রাজনীতি

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সিরিয়ার ভেতরে এই ড্রাগের উৎপাদন একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এটা এখন "নতুন ধরনের অস্ত্র" হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে—

(১)  যুদ্ধ তহবিল সংগ্রহে

(২)  জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে

(৩)  বিদেশি বাজারে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে

 

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ক্যাপটাগনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে:

(১)  সিরিয়ায় ড্রাগ চেইনকে লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞা ও অর্থনৈতিক চাপ দেওয়া হচ্ছে।

(২)  প্রতিবেশী দেশগুলো সীমান্তে উন্নত স্ক্যানার ও নজরদারি বাড়িয়েছে।

 

বাংলাদেশে কি এর অস্তিত্ব আছে?

এখন পর্যন্ত Captagon বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রবেশ করেনি। তবে অনেকে সন্দেহ করেন, জঙ্গি সংগঠনগুলোতে বিশেষ করে আত্মঘাতী জঙ্গিদের মধ্যে এর ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের অজান্তে পানীয় দ্রব্যের সংমিশ্রণে এর বিতরণ ও সেবন করানো হয়ে থাকতে পারে বলেও অনেকে সন্দেহ করে থাকেন। এছাড়া ইয়াবা ও অন্যান্য সিন্থেটিক মাদকের বিস্তারের প্রেক্ষিতে এটি একটি সম্ভাব্য ঝুঁকি হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যদি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত প্রবাসীদের মাধ্যমে এর প্রচলন ও বিস্তার ঘটে।

 

উপসংহার

Captagon ড্রাগ একটি ভয়াবহ মাদক, যা শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। এটি একটি নিষিদ্ধ ও ধ্বংসাত্মক রাসায়নিক অস্ত্র, আধুনিক বিশ্বের সংঘাত ও অর্থনীতির অংশ হয়ে উঠতে পারে।

সতর্কতা, শিক্ষা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাই এর মোকাবেলায় একমাত্র পথ।

Post a Comment

Previous Post Next Post