১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নাটকীয় বাঁক বদলের দিন। দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসনের ঘোষণা দেন। এই ঘটনার পেছনে যেসব অজুহাত বা পরিস্থিতি দেখানো হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি ছিল ‘মন্ত্রীর বাড়িতে খুনি’—একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা যা শেষ পর্যন্ত সামরিক হস্তক্ষেপের একটা বড় "কারণ" হিসেবে ব্যবহার হয়।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৮১ সালের শেষ দিকে বা ১৯৮২ সালের শুরুতে। তৎকালীন বিএনপির এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর ঢাকার বাসায় এক সন্দেহভাজন অপরাধীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। অভিযোগ ছিল, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছাড়াই, একেবারে "নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে" তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার ধরন, এর সঙ্গে রাজনীতিকদের জড়িত থাকা এবং ঘটনার মিডিয়াতে ফাঁস হওয়া—সব মিলিয়ে তা ছিল নজিরবিহীন।
জনমত ও অস্থিরতা
ঘটনার পরপরই জনমনে সৃষ্টি হয় তীব্র ক্ষোভ। আইনের শাসনের ঘাটতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং ক্ষমতাসীনদের দম্ভ—সবকিছু নিয়েই জনগণের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। একই সময় দেশে চলছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতা। সেনাবাহিনী সেই সুযোগে দাবি তোলে যে, দেশ অরাজকতার দিকে যাচ্ছে এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে তাদের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
এরশাদের 'দায়িত্ব গ্রহণ'
সেনাপ্রধান এরশাদ ঠিক এই সময়টাতেই সামনে আসেন। ‘জাতীয় স্বার্থে’ ও ‘দেশকে রক্ষা করার দায়িত্বে’ তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি দাবি করেন, দেশে নৈতিক অবক্ষয় ও আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির কারণে তাঁকে বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, মন্ত্রীর বাড়ির এই হত্যাকাণ্ডকে এরশাদ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেন জনগণের একাংশের সহানুভূতি ও সেনা হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা প্রমাণে।
এটি কি ছিল একটি পরিকল্পিত উপলক্ষ?
এই প্রশ্ন এখনও অনেক গবেষকের মনে রয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ডটি প্রকৃতপক্ষে কতটা আকস্মিক আর কতটা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়েছিল—এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, এই ঘটনাটি সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য একটি “Narrative Device” বা পরিকল্পিত যুক্তির খামচা ছিল।
সেনাবাহিনী আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল ক্ষমতা গ্রহণে, শুধু একটি যথাযথ সময় ও অজুহাত প্রয়োজন ছিল।
ইতিহাসের শিক্ষাগুলো
১. দুর্বল গণতন্ত্র সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করে।
২. আইনের শাসনের ব্যর্থতা দেশকে বিপদে ফেলতে পারে।
৩. একটি ঘটনাকে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডায় রূপান্তর করা সহজ, যদি জনমনে হতাশা ও ক্ষোভ থাকে।
৪. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব সামরিক হস্তক্ষেপকে ‘বিকল্প পথ’ হিসেবে তুলে ধরে।
উপসংহার
'মন্ত্রীর বাড়িতে খুনি' শুধু একটি হত্যাকাণ্ড ছিল না। এটি হয়ে উঠেছিল একটি রাজনৈতিক টার্নিং পয়েন্ট—যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে থামিয়ে সামরিক একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়। এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত ক্ষমতার লোভ কীভাবে একটি জাতির গতিপথ বদলে দিতে পারে।
إرسال تعليق