দশ মাসে গ্রেফতার তিন লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৮ জনঃ রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা না কি পরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণ?

 
ছবি" সমকাল এর সৌজন্যে

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে যে ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তা হলো "গত ১০ মাসে গ্রেপ্তার ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৮ জন"—একটি সংখ্যাগত রেকর্ড, কিন্তু মানবিক ও সাংবিধানিক দিক থেকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার পক্ষ এটিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার 'অভূতপূর্ব সাফল্য' বলে প্রচার করছে, অপরদিকে বিরোধীপক্ষ ও নাগরিক সমাজ এটিকে 'দমন-পীড়নের নজিরবিহীন অভিযান' হিসেবে দেখছে।

 

সংখ্যার পেছনের প্রশ্ন

তিন লাখ ৫৯ হাজার! শুধু একটি সংখ্যা নয়—এই সংখ্যাটি নির্দেশ করে এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে ব্যাপকহারে জনগণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, এত বিপুল সংখ্যক মানুষ কি হঠাৎ করে অপরাধী হয়ে উঠল, নাকি এটি ছিল একটি পূর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল?

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শ্রমিক, এমনকি সাধারণ মানুষও। অনেকের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, আবার অনেককে পরিত্যক্ত মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

 

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য?

সরকারি ভাষ্যে বলা হচ্ছে, এই অভিযান অপরাধ ও মাদক নির্মূলের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ০৫ আগস্ট পরবর্তী সময়টিতে এই ধরনের গণগ্রেপ্তারকে অনেকেই দেখছেন রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করার একটি হাতিয়ার হিসেবে। বিশেষ করে নতুন গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার যে আরও ‘নিরাপত্তাকেন্দ্রিক’ অ্যাপ্রোচ নিচ্ছে, তা স্পষ্ট।

বিরোধীদল ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, এসব গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিরোধী কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি ছড়িয়ে রাজনৈতিক স্থবিরতা তৈরি করা হচ্ছে।

 

মানবাধিকার ও আইনের শাসন

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণগ্রেপ্তার কোনোভাবেই সুস্থ আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে-কোনো গ্রেপ্তারের সময় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে জানানো এবং দ্রুত আদালতে হাজির করানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এসব নিয়ম মানা হচ্ছে না।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে। কারা এই গ্রেপ্তারদের টার্গেট, কী প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে, এবং কতটা আইনি স্বচ্ছতা ছিল—এসব প্রশ্নের কোনো পরিষ্কার উত্তর এখনো মেলেনি।

 

রাষ্ট্রের চরিত্রের প্রতিফলন

এত বৃহৎ পরিসরে গ্রেপ্তার শুধুই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা নয়; এটি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। রাষ্ট্র যখন বিরোধী মত, সমালোচনা কিংবা গণআন্দোলনকে শত্রু হিসেবে দেখে, তখনই এই ধরনের দমনমূলক কৌশল সামনে আসে। এটি দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক মেরুকরণ, জনমনে আতঙ্ক, এবং গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি সৃষ্টি করে।

 

উপসংহার: দরকার জবাবদিহি ও আইনি স্বচ্ছতা

তিন লাখ ৫৯ হাজার গ্রেপ্তার সংখ্যা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক, মানবিক ও সাংবিধানিক সংকেত। এই পরিস্থিতির নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যদি সত্যি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে, তাহলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। কিন্তু যদি এটি হয় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ—তাহলে তা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য এক ভয়ঙ্কর সংকেত।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জবাবদিহি নিশ্চিত করার, নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে আনা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার এখন অতি জরুরী।

Post a Comment

أحدث أقدم