মৃত্যুকে হার মানিয়ে জীবন ফিরিয়ে আনলেন লখনৌয়ের চিকিৎসকরা: ডিপ হাইপোথার্মিক সার্কুলেটরি অ্যারেস্টে সাফল্য!

 

ছবিঃ দ্য ওয়াল এর সৌজন্যে

“মানুষ বুদ্ধির পরিচয় দেয় জ্ঞানের বিষয়ে,
যোগ্যতার পরিচয় দেয় কৃতিত্বে,
আপনার পরিচয় দেয় সৃষ্টিতে।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিজ্ঞান যেখানে থেমে যায়, সেখান থেকেই শুরু হয় মানুষের অদম্য মনোবল আর সৃষ্টিশীলতা। তারই এক জীবন্ত উদাহরণ লখনৌয়ের কিং জর্জেস মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির (KGMU) চিকিৎসকদের হাতে ঘটে গেল। মাত্র ৬ মিনিটের জন্য এক রোগীকে ‘বৈজ্ঞানিকভাবে মৃত’ করে তাঁকে আবার জীবিত করে তোলার এই অবিশ্বাস্য কাহিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক স্বর্ণাক্ষরে লেখা অধ্যায় হয়ে থাকবে।

 

কী ঘটেছিল?

২৮ বছর বয়সী এক যুবতী, আশা (আসল নাম গোপন রাখা হয়েছে), যার এক বছর আগে হৃদযন্ত্রে দুটি ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, তিনি আবারও বুকের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসেন। পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁর প্রতিস্থাপিত ভালভে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র তৈরি হয়েছে। এটি দ্রুত সারাতে না পারলে তাঁর প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল।

কিন্তু এই ফুটো সারানোর অস্ত্রোপচার অত্যন্ত বিপজ্জনক। অপারেশনের সময় হৃদযন্ত্রের সংবেদনশীল অংশে কাজ করতে গেলে যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি।

 

ডিপ হাইপোথার্মিক সার্কুলেটরি অ্যারেস্ট (DHCA): মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা

সমাধান? রোগীকে অস্থায়ীভাবে “মৃত” করে দেওয়া।

এই পদ্ধতির নাম – Deep Hypothermic Circulatory Arrest (DHCA)। এখানে কী হয়?

  • রোগীর দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে আনা হয় মাত্র ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে
  • রক্তসঞ্চালন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়
  • মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা থামিয়ে দেওয়া হয়।
  • শরীর থাকে একদম নিস্তেজ – একজন বৈজ্ঞানিকভাবে মৃত মানুষের মত

এই অবস্থা সর্বোচ্চ ৬-৭ মিনিটের জন্য বজায় রাখা যায়। তার মধ্যেই অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করতে হয়।

KGMU-র চিকিৎসকেরা সেই ৬ মিনিটের জীবন-মৃত্যুর সীমারেখায় দাঁড়িয়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন।

 

অপারেশনের মুহূর্তগুলো: সাহস, নিখুঁত পরিকল্পনা ও সময়ের প্রতিযোগিতা

যখন আশা’র শরীর ছিল মৃতের মত, তখনই চিকিৎসকেরা সেই ক্ষতিগ্রস্ত ভালভ ঠিক করে ফেলেন। সময় ছিল মাত্র ছয় মিনিট। ভুলচুকের কোনো সুযোগ ছিল না। এরপর ধাপে ধাপে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ানো হয়, রক্তচলাচল শুরু করা হয়, এবং একসময় আশা ফিরে পান প্রাণের স্পন্দন

 

ভারতে এই চিকিৎসা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে এমন উচ্চমানের চিকিৎসা এখনো অনেক হাসপাতালেই অপ্রাপ্য। উন্নত বিশ্বে DHCA ব্যবহৃত হলেও, এটি ভারতের একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে প্রথম প্রয়োগ। এই কীর্তি শুধুমাত্র আশা’র জীবন বাঁচায়নি, বরং হাজার হাজার হৃদরোগীর জন্য নতুন আশার আলো দেখিয়েছে।

মানবিকতা ও বিজ্ঞানের মিলনবিন্দু

এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, চিকিৎসা শুধুমাত্র বিজ্ঞান নয়, এটি এক ধরনের শিল্প, সাহস, ও মানবিক স্পর্শের সমন্বয়। KGMU-র চিকিৎসকেরা শুধুমাত্র কৃতিত্ব অর্জন করেননি, তাঁরা একবার প্রমাণ করে দিলেন যে মানুষের সংকল্প ও প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগে অমীমাংস্য সমস্যারও সমাধান সম্ভব।

 

উপসংহার

লখনৌয়ের এই ‘মিরাকেল অপারেশন’ এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে চিকিৎসা জগতে। আশার মত হাজারো রোগীর জন্য এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে জীবনের শেষ আলো হয়ে উঠতে পারে। এ যেন আধুনিক যুগের এক নিঃশব্দ বিপ্লব — যেখানে মৃত্যু নয়, জীবনই শেষ কথা বলে

ঘটনাটি যদিও দুই বছর আগের। পরে আর এমন চিকিৎসা দিয়েছে কিনা হাসপাতালটি তা জানা যায়নি। পুরনো হলেও ঘটনাটি সবার জানার জন্য আবারও পোষ্ট দিলাম। আপনিও এই ঘটনার কথা আরও অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নিন। কারণ, এমন সাফল্য শুধু গর্ব নয়, প্রেরণাও বটে।

 


Post a Comment

أحدث أقدم