ঘুষ নেয়ার অভিনব পদ্ধতি!
![]() |
ঘুষ! |
কাকরাইলে
অনেকগুলো সরকারি অফিস আছে। তার মধ্যে দুদকের একটা অফিস। গেটের বাইরে একটা অভিযোগ
বাক্স রাখা আছে, যাতে করে লোকজন খুব সহজেই তাদের অভিযোগ জানিয়ে যেতে পারেন। তাতে অভিযোকারীর নাম, পরিচয় গোপন থাকে, আবার সে নিরাপদেও থাকে। অভিযোগ বাক্সে জমা
পড়া চিঠিগুলোর গুরুত্ব বুঝে মাঝেমধ্যে তদন্ত করে দেখা হয়।
সেদিন
ঠিক এমন একটা চিঠি নিয়ে বসেছিলেন দুদক অফিসার কফিলউদ্দিন। চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে
গড়িয়ে পড়ছিলেন। পাশের চেয়ারে বসা দীর্ঘদিনের সহকর্মী বাশার ভাই ভ্রু কুঁচকে বলে,
'কী হইছে কফি ভাই?'
বাশার
ছোট করে কফিলকে কফি ভাই বলে ডাকে। অবশ্য আরেকটা কারণ আছে। কফিল ভাই ঘন্টায় ঘন্টায়
কফি খায়। সেই জন্যই এই নাম নিয়ে কফিল ভাই কখনও আপত্তি করেনি।
কফিল
হাতের চিঠিটা নামিয়ে রেখে বলে, 'এক লোক একজন সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ
করেছে যে উনি নাকি প্রতি ফাইল সাইন করতে পাঁচটা করে শিঙাড়া ঘুষ নেন। আচ্ছা বলেন,
এটা কোনো দূর্নীতি হইল? বেচারা তো আর টাকা চায় নাই। তার হয়তো শিঙাড়া খুব পছন্দ।'
বাশার
চোখের চশমা নামিয়ে বলে, 'এমন অদ্ভুত অভিযোগ কখনও শুনি নাই তো। আর ওই সরকারি
অফিসারটাও তো আরও অদ্ভুত। ফাইল পাশ করতে শিঙাড়া চায়। চলেন না, একদিন ছোটখাটো তদন্ত
করে আসি আর শিঙাড়াও খাইয়া আসি।'
কফিলউদ্দিন
তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, 'ভাই, আপনি তো জানেন এখন হাতে কত বড়ো বড়ো রুই কাতলার কেস
ঝুলছে। এইসব ফালতু কেস নিয়ে সময় ব্যয় করার মানে নেই।'
এমন
সময় পিয়ন এসে এক কাপ কফি দিয়ে যায়। কফিলউদ্দিন আয়েশ করে কফিতে চুমুক দেয়। কেন যেন
হঠাৎ করে শিঙাড়া খেতে ইচ্ছে করছে।
এর
কিছুদিন পর আবার সেই চিঠিটা আসে। কফিলউদ্দিন ভ্রু কুঁচকে চিঠিটা পড়ে। তারপর গলা
তুলে বলে, 'বাশার ভাই, গেটের বাইরের ওই অভিযোগ বাক্সটা সরিয়ে ফেললে হয় না?'
বাশার
জিজ্ঞাসু গলায় বলে, 'কেন কফি ভাই, কী হয়েছে?'
কফিল
চিঠিটা দেখিয়ে বলে, 'সেই লোক আবার চিঠি পাঠিয়েছে। এবার অভিযোগ হলো সেই সরকারি
অফিসার নাকি ফাইল প্রতি পাঁচটার জায়গায় দশটা করে শিঙাড়া নিচ্ছে। তা তুই দশটা
শিঙাড়া কিনে দে। ফালতু সব অভিযোগ।'
বাশারের
খুব মজা লাগে। আগ্রহের গলায় বলে, 'কফি ভাই, চলেন না একদিন আমরা একটা ফাইল নিয়া
যাই। দেখি আসলে ব্যাপারটা কী? আমরাও না হয় শিঙাড়া খাইয়া আসলাম।'
কফিলউদ্দিন
ঠোঁট উল্টায়, 'আপনি যান, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ওই অফিসে আমাদের লোক আছে।
তাকে বললেই একটা ভুয়া ফাইল পাশের ব্যবস্থা করে দেবে।'
বাশার
উৎসাহী গলায় বলে, 'আচ্ছা, কফি ভাই, এমন মজার অভিযোগ আগে শুনি নাই। লোকটাকে দেখেই
আসি।'
সপ্তাহখানেক
পরে বাশার একদিন নিজেই যায়। সেই সরকারি অফিসারের অফিসটা ওদের পাশেই। আগে থেকেই সব
ঠিক করা ছিল। আজ সকাল এগারোটায় উনি সময় দিয়েছেন। বাশার অপেক্ষা করছিল। অফিসারের
নাম তাজুল ইসলাম। আসলে ছোট অফিসার না, উনি পরিচালক পদে আছেন। এত বড়ো পোস্টের একজন লোক
এমন অদ্ভুত কাজ করছে, বিশ্বাস হয় না।
ঠিক
এগারোটায় বাশারের ডাক পড়ে। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢোকে বাশার, সালাম দেয়। তাজুল
ইসলাম গম্ভীরমুখে বলে, 'কী চাই?'
বাশার
ভালো করে দেখে। লোকটার মাথায় একটা মস্ত টাক। গোলগাল চেহারা, বেশ স্বাস্থ্যবান।
আহারে, লোকটা শিঙাড়া খেয়েই বুঝি এমন নাদুসনুদুস স্বাস্থ্য বানিয়েছেন।
বাশার
গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, 'স্যার, আমার একটা ফাইল ছিল।'
তাজুল
মাথা নেড়ে বলে, 'হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি কাজ করে রেখেছি। আপনি শিঙাড়া এনেছেন?'
বাশারের
বুক ধুকপুক করে উঠে। অভিযোগ দেখি সত্য। এই লোক আসলেই শিঙারা ঘুষ নেন।
বাশার
একটু তোতলানো গলায় বলে, 'না আনিনি স্যার। কয়টা আনব?'
তাজুল
ওর ফাইলটা নেড়েচেড়ে বলে, 'বেশি না, আপনি পাঁচটা শিঙাড়া নিয়ে আসেন।'
বাশার
রুম থেকে বেরিয়ে নিচে আসে। একটু এগোতেই একটা টং দোকান দেখতে পায়। কড়াইয়ে গরম গরম
শিঙাড়া ভাজা হচ্ছে। নিজে দুটো শিঙাড়া খায়। তারপর পঞ্চাশ টাকা দিয়ে পাঁচটা শিঙাড়া
কেনে। দোকানি সাথে কিছু কাটা পেঁয়াজ আর বিট লবণ দিয়ে দেয়।
বাশার
শিঙাড়া নিয়ে আবার তাজুল ইসলামের রুমে ঢোকে।
বাশার
তেলতেলে গলায় বলে, 'এই যে স্যার, একদম গরম গরম শিঙাড়া নিয়ে এসেছি।'
তাজুল
হাসে, 'ভাই, আমি সব দোকানের শিঙাড়া খাই না। আপনি এই অফিস থেকে নেমে বাম দিকে দুই
মিনিট হেঁটে গেলে একটা রেস্টুরেন্ট দেখবেন। নাম - 'লাজুকলতা রেস্টুরেন্ট'। ওইখানে
গিয়ে আমার নাম বললেই ওরা স্পেশাল শিঙাড়া বানিয়ে দেবে। যান, দেরি করবেন না। আমার
হাতে অনেক কাজ।'
বাশার
ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তারপর মাথা নেড়ে বাইরে আসে। বাপ রে, একদম নিজের পছন্দ করা
আলাদা দোকান থেকে শিঙাড়া আনতে হবে?
অফিস
থেকে নেমে বাশার একটু হাঁটতেই লাজুক লতা রেস্টুরেন্টটা পেয়ে যায়। রেস্টুরেন্টে
ঢুকতেই ক্যাশে বসা লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে, 'তাজুল স্যারের জন্য পাঁচটা স্পেশাল
শিঙাড়া দেন তো।'
ক্যাশে
বসা লোকটা একটু নড়েচড়ে উঠে। তারপর নিজে চেয়ার থেকে উঠে এসে তাকে নিয়ে ভেতরে আলাদা
একটা খালি টেবিলে বসায়। এক ফাঁকে কাউকে উদ্দেশ্য করে বলে, 'ওই, পাঁচটা কলিজা শিঙাড়া
দে।'
বাশার
হাসে। লোকটা বললেই পারত কলিজা শিঙাড়া খাবে।
একটু
পর সুন্দর একটা লাল রঙের বাহারি ঠোঙায় শিঙাড়া আসে। বাশার মানিব্যাগ বের করে বলে,
'ভাই, শিঙাড়া কত করে?'
ক্যাশিয়ার
লোকটা ভ্রু কুঁচকে বলে, 'আপনি নতুন নাকি? স্যারের শিঙাড়ার রেট জানেন না?'
বাশার
মাথা নাড়ে, 'না তো। কত করে বলেন।'
ক্যাশিয়ার
গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, 'দশ হাজার কইরা। পাঁচটার দাম পঞ্চাশ হাজার।'
বাশারের
চোখ বড়ো হয়ে যায়। এতক্ষণে বুঝতে পারে ব্যাপারটা। ঘুষ খাবার একটা অভিনব টেকনিক।
তারমানে ছোটখাটো ফাইলে পঞ্চাশ হাজার টাকা। আর ফাইল বড় হলে দশটা শিঙাড়া, মানে এক
লাখ টাকা।
বাশার
মন খারাপ গলায় বলে, 'ভাই, আমি তো অত টাকা নিয়া আসি নাই। কাইল আবার আসমু।'
ক্যাশিয়ার
লোকটা অসন্তুষ্ট গলায় বলে, 'রেট না জাইনা হুদাই শিঙাড়া কিনতে আসেন ক্যান। যান,
টাকার বন্দোবস্ত করেন।'
সেদিন
অফিসে গিয়ে কফিলউদ্দিনকে পুরো ঘটনা খুলে বলতেই উনি হতভম্ব হয়ে যান, 'কী বলেন! এত্ত
বড়ো শেয়ানা। দাঁড়ান, এর ব্যবস্থা নিতেছি।'
পরদিনই
লাজুকলতা রেস্টুরেন্টের ক্যাশিয়ার সহ তাজুল ইসলামকে আটক করা হয়। বাশারের পঞ্চাশ
হাজার টাকা দিয়ে পাঁচটা শিঙাড়া কেনার দৃশ্যটা গোপনে ভিডিয়ো ধারণ করা হয়। এই
শিঙাড়া যে তাজুল ইসলামের জন্য কেনা হচ্ছে সেটাও।
পুরো
দেশের মিডিয়া যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় তাজুল ইসলাম অনেক দিন ধরেই
এমন অভিনব কায়দায় ঘুষ নিচ্ছিলেন। আর লাজুকলতা রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি নিজেই। এর
ক্যাশিয়ার তার স্ত্রীর ছোট ভাই। অর্থাৎ শ্যালক আর দুলাভাই মিলে পুরো ঘুষ বাণিজ্যটা
চালাতেন।
তাজুল
ইসলামের বক্তব্য নিতে গেলে সে শুধু গম্ভীরমুখে বলেছে, 'শালা আমাকে ডুবিয়েছে।'
©মোহাম্মদ
হাবিবুর রহমান সুবাস