![]() |
রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ |
অনেকে জেনে বিস্মিত হন যে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন হওয়ার পরও পাকিস্তান—যার অংশ ছিল বর্তমান বাংলাদেশ—আরও প্রায় নয় বছর বৃটিশ রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল। ২৩ মার্চ ১৯৫৬ সালে নতুন সংবিধান কার্যকর হওয়ার মাধ্যমে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং পাকিস্তান একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। তার আগে পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন বৃটেনের সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ এবং পরে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। |
স্বাধীনতার পর রাজতন্ত্রের কাঠামো
ভারতীয় স্বাধীনতা আইন
অনুযায়ী পাকিস্তানকে ‘ডোমিনিয়ন’ (আধিপত্য) মর্যাদা দেওয়া
হয়।
অর্থাৎ
দেশটি
নিজস্ব
সংসদ,
মন্ত্রিসভা ও বিচারব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হলেও
রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন
বৃটিশ
সম্রাট। সম্রাট
পাকিস্তানে তার
প্রতিনিধিত্বের জন্য
গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত করতেন, যিনি কার্যত
পাকিস্তানের প্রধান
নির্বাহী হিসেবে
দায়িত্ব পালন
করতেন।
রাজা ষষ্ঠ জর্জ |
পাকিস্তানের স্বাধীনতা উপলক্ষে রাজা তার জনগণকে অভিনন্দন বার্তা পাঠান। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে লর্ড মাউন্টব্যাটেন অভিনন্দনবার্তাটি পাঠ করেছিলেন। বার্তায় রাজা বলেছিলেনঃ
"চুক্তির মাধ্যমে আপনাদের স্বাধীনতা অর্জন সারা বিশ্বের সকল স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য আপনারা একটি উদাহরণ স্থাপন করেছেন”। আমার সহানুভূতি এবং সমর্থনের বিষয়ে আপনারা সর্বদা আশ্বস্ত থাকতে পারেন। কারণ আমি মানবতাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আপনাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা লক্ষ্য করেছি।”
১৯৪৭–১৯৫২
সাল
পর্যন্ত রাজা
ষষ্ঠ
জর্জ
পাকিস্তানের সার্বভৌম ছিলেন।
তিনি
মোহাম্মদ আলী
জিন্নাহকে প্রথম
গভর্নর-জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেন।
জিন্নাহ শপথ
নিয়েছিলেন পাকিস্তানের সংবিধান রক্ষার
পাশাপাশি সম্রাটের প্রতি
আনুগত্য বজায়
রাখার
প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
জিন্নাহর শপথবাক্যঃ
"আমি, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকারের বিশ্বাস এবং আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এবং আমি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের অফিসে মহামহিম রাজা ষষ্ঠ জর্জের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব।"
![]() |
কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ |
মদ্যপ মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ তার অফিস কক্ষে (অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের মতো কাশতে কাশতে) মারা যান। রাজা ষষ্ঠ জর্জ একটি রাজকীয় ডিক্রির মাধ্যমে ‘স্যার খাজা নাজিমুদ্দিনকে’ পরবর্তী গভর্নর-জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেন। ডিক্রীতে রাজা বলেনঃ
"কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দুঃখজনক মৃত্যুর কারণে শূন্যপদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে খাজা নাজিমুদ্দিনকে পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর-জেনারেল হিসাবে নিয়োগ করতে পেরে আমি খুশি।"
![]() |
খাজা নাজিমুদ্দিন |
![]() |
খাজা গোলাম মোহাম্মদ |
রাজা ষষ্ঠ জর্জ ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে ঘুমের মধ্যেই মারা যান।
রাজার মৃত্যুতে পাকিস্তানে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। রাজার মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে
৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সব সরকারি অফিস বন্ধ ছিলো। সমস্ত চিত্তবিনোদন স্থান এবং
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিলো। সরকার সমস্ত অফিসিয়াল ব্যস্ততা বাতিল করে। বেশিরভাগ
পাকিস্তানি সংবাদপত্র ৭ ফেব্রুয়ারি কালো বর্ডার দিয়ে প্রকাশ করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারী
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন পাকিস্তান জুড়ে দুই মিনিটের জাতীয় নীরবতা পালন করা হয়।
রাজার জীবনের প্রতিটি বছরের জন্য একটি হিসেবে ৫৬টি তোপধ্বনি দেয়া হয়। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার
দিন পর্যন্ত সকল স্থানে পাকিস্তানি পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
পাকিস্তানের গণপরিষদে, ডোমিনিয়ন ফেডারেল আইনসভায় প্রধানমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন,
"রাজার রাজত্বকাল পাকিস্তানীরা সর্বদা স্মরণ করবে। তার সময়কালে
ভারত- পাকিস্তান উপমহাদেশের মুসলমানরা নিজেদের জন্য একটি স্বদেশ তৈরি করেছিলো।"
রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের
রাজত্বকাল (১৯৫২-১৯৫৬)
৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ এর মৃত্যুর পর তার বড় মেয়ে প্রিন্সেস
এলিজাবেথ পাকিস্তানের নতুন রাজা বা রাণী হন। পাকিস্তান সহ তার রাজ্য জুড়ে রা্ণী
নিজেকে সার্বভৌম হিসেবে ঘোষণা করেন। পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে ২১ তোপধ্বনি স্যালুট দিয়ে
সম্মানিত করা হয়।
১৯৫৩ সালে তার রাজ্যাভিষেকের সময় দ্বিতীয় এলিজাবেথ্কে পাকিস্তান এবং অন্যান্য
স্বাধীন কমনওয়েলথ রাজ্যের রাণী হিসাবে মুকুট পরানো হয়। তার রাজ্যাভিষেকের শপথে রা্ণী
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে "পাকিস্তানের জনগণ তাদের নিজস্ব আইন ও রীতিনীতি অনুযায়ী
তাদের দেশ শাসন করবে"।
রাণীর রাজ্যাভিষেকের গাউন প্রতিটি কমনওয়েলথ দেশের ফুলের প্রতীক দিয়ে সূচিকর্ম করা হয়েছিলো। তাতে পাকিস্তানের তিনটি প্রতীক ছিল: ওট-আকৃতির হীরা এবং সোনালি স্ফটিকের ফ্রন্ডে গম; সবুজ রেশমের পাতা দিয়ে রূপালী তৈরি তুলা; এবং সবুজ সিল্ক এবং সোনালী সুতোয় সুচিকর্ম করা পাট।
রাজ্যাভিষেকের জন্য অ্যাবেতে পাকিস্তানিদের জন্য ৮০টি আসন সংরক্ষিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া, তার স্ত্রী এবং দুই পুত্রসহ ২ জুন রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এরপর ৩ জুন থেকে ৯ জুন ১৯৫৩ পর্যন্ত তিনি লন্ডনে কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রীর সম্মেলনে যোগদান করেন।
![]() |
মোহাম্মদ আলি বগুড়া |
পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা সমান করার চেষ্টা করার জন্য ১৯৫৩ সালে
গভর্নর-জেনারেল স্যার গোলাম মুহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত
করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করার জন্য রাণীকে অনুরোধ করেছিলেন।
কিন্তু রাণী বিষয়টীতে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করেন।
১৯৫৫ সালের কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রীর সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সহ-কমনওয়েলথ নেতাদের জানিয়েছিলেন যে,
"পাকিস্তান একটি প্রজাতন্ত্রী সংবিধান গ্রহণ করবে, তবে পাকিস্তান কমনওয়েলথের সদস্য হিসেবে থাকতে চায়।"
কমনওয়েলথ নেতারা ৪ ফেব্রুয়ারি
একটি ঘোষণা জারি করেন, যেখানে বলা হয়েছিল:
“পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানের জনগণের অভিপ্রায়
সম্পর্কে কমনওয়েলথের অন্যান্য সরকারকে জানিয়েছে যে, পাকিস্তানে একটি নতুন সংবিধানে
গৃহীত হতে চলেছে। ফলে পাকিস্তান একটি সার্বভৌম স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবে। পাকিস্তান
সরকার অবশ্য কমনওয়েলথ অফ নেশনস-এর পূর্ণ সদস্যপদ অব্যাহত রাখার এবং তার স্বাধীন সদস্য
দেশগুলির স্বাধীন অ্যাসোসিয়েশনের প্রতীক হিসাবে এবং কমনওয়েলথের প্রধান হিসাবে রাণীকে
তার গ্রহণযোগ্যতা অব্যাহত রাখার জন্য পাকিস্তানের ইচ্ছা ঘোষণা ও নিশ্চিত করেছে।”
১৯৫৫ সালে পাকিস্তান সরকার রাণীর কাছে সুপারিশ করে, ‘পাকিস্তানে রাণীর প্রতিনিধি
হিসেবে মেজর-জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পরবর্তী গভর্নর-জেনারেল হিসেবে স্যার গোলাম
মুহাম্মদের স্থলাভিষিক্ত করা উচিত। ১৯ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় যে,
মহামান্য রাণী মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পাকিস্তানের গভর্নর-জেনারেল হিসেবে
নিযুক্ত করেছেন যা ৬ অক্টোবর ১৯৫৫ থেকে কার্যকর হবে। মির্জা রাণীর কাছ থেকে রাজকীয়
সাইন-ম্যানুয়াল পাঠ করার পর অফিস গ্রহণ করেন।
সংবিধান ও প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর
১৯৫৫ সালে
কমনওয়েলথ সম্মেলনে পাকিস্তান ঘোষণা
দেয়
যে
তারা
একটি
প্রজাতন্ত্রী সংবিধান গ্রহণ
করবে,
তবে
কমনওয়েলথের সদস্য
থাকবে।
অবশেষে
২৩
মার্চ
১৯৫৬
সালে
পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র ঘোষিত
হয়
এবং
বৃটিশ
রাজতন্ত্রের অধ্যায়
সমাপ্ত
হয়।
রাণী এলিজাবেথ সেই
সময়ে
পাকিস্তানের প্রথম
রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জাকে অভিনন্দন জানিয়ে
বার্তা
পাঠান।
পরবর্তীতে তিনি
১৯৬১
ও ১৯৯৭ সালে কমনওয়েলথ প্রধান
হিসেবে
পাকিস্তান সফরও
করেন।
![]() |
রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম সফর করেন |
প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনিক প্রতীক
১৯৫৬ সালের
আগে
পাকিস্তান সেনা,
নৌ
ও বিমানবাহিনীতে রাজকীয় মুকুটের প্রতীক
ব্যবহৃত হতো।
নৌবাহিনীর জাহাজগুলোর নামের
আগে
লেখা
থাকত
HMPS (His/Her Majesty’s Pakistan Ship)। বিমান
বাহিনীর নামও
ছিল
“Royal Pakistan Air Force।” প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর “Royal” উপাধি বাদ
দেওয়া
হয়।
বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসন
সেই সময় পাকিস্তানের আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধকে ধরা হতো “ক্রাউনের বিরুদ্ধে অপরাধ” হিসেবে। আদালতে মামলা চলত The Crown vs. [নাম] শিরোনামে। গভর্নর-জেনারেল ছিলেন রাজার পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধি, যিনি সংসদ ভেঙে দেওয়া, মন্ত্রী নিয়োগ বা অপসারণ করার মতো সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা ভোগ করতেন।
সাবেক পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ বাংলাদেশ হিসেবে স্বাধীন হওয়ার ইস্যুতে ১৯৭২ সালে পাকিস্তান কমনওয়েলথ ত্যাগ করে।
উপসংহার
১৯৪৭ সালে
স্বাধীনতা অর্জন
করলেও
পাকিস্তান প্রকৃত
অর্থে
পূর্ণ
সার্বভৌমত্ব লাভ
করে
১৯৫৬
সালে
প্রজাতন্ত্র ঘোষণার
মধ্য
দিয়ে।
প্রায়
এক
দশক
রাজতন্ত্রের অধীনে
থেকে
পাকিস্তান কমনওয়েলথের ভেতরে
থেকে
একটি
স্বাধীন সত্ত্বায় রূপ
নেয়।
এই
অধ্যায়
শুধু
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসেই নয়,
বাংলাদেশের ইতিহাসেরও একটি
গুরুত্বপূর্ণ অংশ,
যা
আমাদের
স্বাধীনতার পথচলার
প্রেক্ষাপট বুঝতে
সাহায্য করে।
Post a Comment